বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এদেশে ইংরেজরা শাসনের নামে শোষন শুরু করে। তারা প্রায় দু’শত বছর বাংলার মানুষের উপর নির্মম অত্যচার, অবিচার, শোষন, বঞ্চনা চালানোর পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়। এবার পাকিস্তানের শাসক গোষ্টি ধর্মের নামে বাংলার জনগণের উপর শোষন, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষন চালায়। যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। যতবারই স্বাধীন হতে চেয়েছে ততবারই তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চলছে। তাই তো স্বাধীনতার স্বাদ তারা বুঝতে পারে নি কখনো। বরাবরের মতো এদেশের মানুষ চাইতেন মুক্তির স্বাদ পেতে। সৃষ্টি কর্তার নিকট আবেদন জানাতেন একজন মুক্তির দূত পাঠাতে। হয়তো দিশেহারা এ জাতির ফরিয়াদ শুনেছিলেন সৃষ্টিকর্তা।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ বাংলার জমিতে পাঠিয়েছিলেন জনগণেল মুক্তির দূত, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রাষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সেদিন মনে হয় আকাশের চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছুর শুভ দৃষ্টি পড়েছিল বাংলার জমি টুঙ্গি পাড়া গ্রামে। পরবর্তীতে আলোময় হয়ে উঠে শেখ লুৎফুর রহমান এবং সায়রার বেগমের ঘরে জন্ম নেয়া ছোট্ট খোকা। কে জানতো এই খোকাই একদিন এ জাতির স্বপ্নের সিংহাসন দখল করে সম্ররাট হয়ে উঠবে। খোকা থেকেই শেখ মুজিব আর বঙ্গবন্ধু কিংবা জাতির পিতা হয়ে মৃত্যুহীন থাকবেন বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। ইতিহাস বলে শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষ ভারত বর্ষে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। প্রায় সোয়া পাঁচ শত বছর আগের কথা। তখনই ভারতীয় উপমহাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে মধ্য প্রাচ্য থেকে বহুপীর, ফকির, আউলিয়া এবং দরবেশের আগমণ ঘটেছিল। বঙ্গীয় এলাকাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইংরেজী ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যমলা বঙ্গীয় এলাকায় সূদুর বাগদাদের হাসানপুর এলাকা থেকে এসেছিলেন হযরত বায়জিদ বোস্তামি (র:)। তার সঙ্গে বাগদাদ থেকে আগত তাঁর শীর্ষদের মধ্যে অন্যতম দরবেশ ছিলেন শেখ আউয়াল। বছর কয়েকের মধ্যে শেখ আউয়াল বাংলার মাটিকে ভালবেসে পেলেন। বিয়ে করেন ঢাকার অদুরে সোনার গাঁয়ের বর্ধিষ্ণু এলাকায় একটি পরিবারের সুন্দরী রমনীকে। বিয়ে করে এখানেই বসবাস শুরু করেন। সুফী দরবেশ আউয়ালের সপ্তম বংশধর, শেখ বোরহান উদ্দিনের চতুর্থ পুরুষ এবং শেখ লুৎফুর রহমানের ঘরে বিংশ শতাব্দির গোড়া দিকে জাতির পিতা বাঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়। বঙ্গবন্ধু যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন ফরিদপুরে তাঁর পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। নদী মাতৃক বাংলাদেশের বাইগার শাখা নদরি তীরে ছোটবেলা কাটিয়েছেন তিনি। এই নদীর সাথে মিথালী গড়ে আরো ডানপীঠে ও দুরন্ত হয়ে উঠেন খোকা। খেলাধুলা, গান, ব্রতচারী করতেন তিনি। এ সম্পর্কে নিজেই লিখেছেন, “ছোট সময়ে আমি খুব দষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করমতা, গান গাইতাম এবং খুব ভাল ব্রতচারী করতে পারতাম”। বাবা মায়ের বড় ছেলে হিসেবে আদরের সবটুকু দখলে ছিল তাঁর। ছোট বেলা থেকেই নদীর মতো ছুটে যেতেন মানুষের কল্যানে। নিজে না খেয়ে খাওয়াতেন অন্যকে। বঙ্গবন্ধুর পিতা ছিলেন সিভল কোর্টের সেরেস্তাদার। চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর একমাত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসের ছেলে বেলায় টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এক পা খুঁত হয়ে যায়। বড় দু বোনের প্রথম জনের বিয়ে দওবাড়ি নুরুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে এবং মেজ বোনের বিয়ে নিকট আত্মীয় শেখ নুরুল হকের সাথে। তৃতীয় বোনের স্বামী বরিশালের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবত এবং চুতর্থ বোনের স্বামী ফরিদপুরের কাশিয়ানা উপজেলার সৈয়দ হোসেন। পরিবারের জোত জমি ভালই ছিল তাদের। নিজস্ব বাড়িতে গোয়ালভরা ধান উঠতো। তা দিয়ে সারা বছর কেটে যেত। বাঙ্গবন্ধুর চাচা খান সাহেব শেখ মোশারফ হোসেন ২৫ বছর পাটগতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের উপদেষ্টা, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের এমপি ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযোদ্ধ চলাকালিন সময় অর্থাৎ ২৫ মার্চের পর পাকিস্তানী খান সেনারা তাদের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেন।
১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেসার সাথে তাঁকে বিয়ে দেয়া হয়। তাঁদের ঘরেই জন্ম নেয় আজকের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহেনা এবং শেখ রাসেল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। তাঁর নামেই দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এদেশ স্বাধীন হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। জীবনের ৪ হাজার ৬’শ ৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। দেশে ফিরে এসেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধ্বংস স্তুপের উপর দাড়িয়ে যখন দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এদেশের কিছু বিপদগ্রস্থ সেনা সদস্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র মিলে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় সেদিন বঙ্গবন্ধুর দ’ই কন্যা বেঁচে যান। এ হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তথ্যসূত্র-মহাপুরুষ, বঙ্গবন্ধুর হত্যার দলিল, অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।